রাজশাহী

অসহায় রহিমার জীবনের লোমহর্ষক গল্প সরের হাট এতিমখানায় কেটেছে তিন বছর

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ
ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক নাগরিক ভাবনা সিদ্ধান্ত নেয় উন্নয়নে বাংলাদেশ শীর্ষক সাপ্তাহিক বিশেষ আয়োজনের। সারা বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের নানা উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরা হয় এ আয়োজনে। ধারাবাহিক ভাবে নাগরিক ভাবনার চৌকষ সাংবাদিক দল অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয় সরকারের উন্নয়ন এবং উন্নয়নে অনিয়মের বিষয়ে। অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় ঢাকা থেকে অনুসন্ধানী সাংবাদিক দল আসেন তালিকাভুক্ত সরকারি ক্যাপিটেশনের টাকায় পরিচালিত হওয়া সরেরহাট কল্যাণী শিশু সদন নামের একটি এতিমখানায়। এ প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ১শ’জন এতিমের বিপরীতে সরকারি ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট হিসেবে পান বছরে ২ কিস্তিতে ২৪ লক্ষ টাকা। কিন্তুু সেখানে নামে মাত্র কয়েক জন এতিম নিবাসী পাওয়া যায়। এছাড়াও সরেরহাট কল্যাণী শিশু সদনের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের অভিযোগে নানা অনিয়ম-দূর্নীতির তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিক দল খুঁজে পান রহিমা নামের এক ভুক্তভোগীকে।

জানা যায়, রহিমার একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। তার জন্ম রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ভায়ালক্ষীপুর ইউনিয়নের বাঁকড়া গ্রামে। তার পিতা মৃত.আফসার মিয়া। মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি পিতাকে হারান। পরবর্তীতে মাতা হুনুফা কেও হারাতে হয়। এরপর অনেক দুঃখ কষ্টে বেড়ে উঠা রহিমার বিয়ে হয় পার্শ্ববর্তী বাঘা উপজেলার হাবাসপুর এলাকার মৃতঃ আব্দুল হালিম মোল্লার সাথে। সংসার জীবনে তার কোল জুড়ে আসে দুটি পুত্র সন্তান। বড় ছেলে মাঈনুল ইসলাম এবং ছোট ছেলে জিহাদ কাওসার। দুই সন্তানের জননী রহিমার সংসার জীবন বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তুু হঠাৎ করেই তার জীবনে নেমে এলো কালবৈশাখী ঝড়। নিমিষেই অন্ধকার নেমে এলো।

তার ছোট ছেলে জিহাদ কাওসারের বয়স যখন ৫ বছর। ঠিক তখন তার স্বামী মারাত্নক অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসা করা হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে। এ সময় অর্থের যোগান দিতে মাথা গোঁজার একমাত্র ঠাঁই, বাড়ির ভিটে খানাও বিক্রি করতে হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে রহিমার শেষ চেষ্টা টুকুও ব্যর্থ হয়। চিকিৎসা কালে তার স্বামী মৃত্যু বরণ করেন। এতে রহিমা অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়েন। দুঃখ কষ্টে ভরা বিভিষীকাময় জীবন নিয়ে দিশেহারা রহিমা।
রহিমার দেওয়া তথ্যানুসারে, তিনি সরের হাট কল্যাণী শিশু সদনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক পল্লী চিকিৎসক শামসুদ্দিন @ শমেস কে বাবা আর তার স্ত্রী কে মা বলে সম্বোধন করতেন। স্বজন হারা রহিমা ভেবেছিলেন তাদেরকেই আপন করে এখানেই কাটিয়ে দিবেন জীবনের বাকী অংশ। কিন্তুু বিধিরাম, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেখানেও বেশি দিন থাকতে পারেনি রহিমা। কথায় আছে অভাগা যে দিকে যায়, সাগর শুখিয়ে যায়।

তিনি জানান, এতিমখানাটিতে তেমন কোন লোকজন থাকে না। নিয়মিত থাকে মাত্র কয়েকজন নিবাসী। যখন কোন সাংবাদিক কিংবা সরকারী কোন কর্মকর্তা তদন্তে আসে তখন পাশের মাদ্রাসা ও এলাকা থেকে বাচ্চাদের ডেকে আনে। তারপর আবার যা তাই, এভাবেই চলতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এতিমখানা নিবাসীদের দেওয়া হয় বাঁশী পঁচা খাবার । প্রতিবাদ করলেই শুনতে হয় অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ। এমনকি হতে হয় মারধরের শিকার। আর মারধর ও গালিগালাজ করতেন এতিমখানাটির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকের ছোট ছেলে শাহদোলা মনসুর @ চঞ্চল। অসহায় এতিমদের প্রতি নির্যাত দেখেও চুপ থাকতেন শামসুদ্দিন ও স্ত্রী এবং বড় ছেলে কমল।

রহিমা অভিযোগ করে বলেন, শুধু বাঁশী পঁচা খাবারই নয় কোরবানির ঈদের দিনেও এতিমের ভাগ্যে জোটেনা এক টুকরা গোস্ত। ফ্রিজ ভর্তি করে গোস্ত রেখে দেয়। কত মানুষ শীতের সময় কম্বল দেয়, যাকাতের কাপড় দেয়। আমাদেরকে নামমাত্র কিছু দিয়ে বাকিগুলো বিক্রি করে। বলতে গেলে এখনও শরীর শিউরে ওঠে, একদিন আমার সাথে থাকা এক মহিলাকে ঘরের দরজা বন্ধ করে বেধড়ক মারপিট করে চঞ্চল। মাইরের চোটে ওই মহিলা রক্তাক্ত জখম হয়। আমি খুব ভয় পেয়ে যাই! তারপরও বিপদ দেখে থেমে থাকতে পারিনি। আহত অবস্থায় ওই মহিলাকে নিয়ে থানায় গেলে পুলিশ বলে আগে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করান পরে দেখছি। তখন বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এ সময় একজন সাংবাদিকের সাথে দেখা হয়। ওই সাংবাদিক ভুক্তভোগীর বক্তব্য শুনে ছবি তুলে এতিমখানায় গেলেও কোন সংবাদ প্রকাশ করেনি। পরের দিন আহত ওই নারী একটু সুস্থ হলে পুনরায় থানায় যাওয়া হলে অজানা কারণে পুলিশ কোন অভিযোগ গ্রহন করেনি। পরে আমি আবার এতিমখানায় গিয়ে রাতের খাবার খেতে বসি। তখন চঞ্চল এসে আমার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ভাতের থালা কেড়ে নিয়ে নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করে আমাকে ও আমার ছেলেকে এতিমখানা থেকে বের করে দেয়। অনেক কষ্ট বুকে চেপে নিরবে চোখের জল ফেলে সেখান থেকে চলে এসেছি।

এখন প্রশ্ন হলো এতিমখানা কর্তৃপক্ষের কাছে যখন মার খেয়ে রক্তাক্ত হতে হয় তখন এই অসহায়েরা কি সেখানে নিরাপদ? এতিমের জন্যে আসা অনুদানের সব কিছু নিয়ে যখন তারা আখের গোছাতে ব্যস্ত। তখন এটি কিভাবে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হতে পারে প্রশ্ন রয়ে যায়? অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রথমে তারা কম্বল বিক্রি করত বাঘার এক কম্বল বিক্রেতার কাছে। পরবর্তীতে বিষয়টি সচেতন মহলে কানাঘুঁষা হতে থাকলে তারা এলাকা থেকে দুরে নাটোরের বনপাড়ার একটি দোকানে বিক্রি করতেন। আর ফ্রিজে রাখা গোস্তও বাদ পড়েনা বিক্রি হতে।অভিযোগের বিষয়ে জানতে এতিমখানার পরিচালককে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফোন রিসিভ না করায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

Back to top button