মোঃ শামীম হোসেনঃ
খুলনা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে চার চিকিৎসককে ‘তুলে আনার’ পর তাদেরকে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে দুজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
শনি ও রোববার খুলনা থেকে চার চিকিৎসককে তুলে আনার পর তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না বলে অভিযোগ ছিল পরিবারের পক্ষ থেকে। এর মধ্যেই সোমবার বিকালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাদের গ্রেপ্তারের কথা জানানো হয়। পরে তাদেরকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় ২০২০ সালের ২০ জুলাই মিরপুর মডেল থানায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। চিকিৎসকরা হলেন- লুইস সৌরভ সরকার, শর্মিষ্ঠা মণ্ডল, নাজিয়া মেহজাবিন তিশা ও মুসতাহীন হাসান লামিয়াকে। এর মধ্যে সৌরভ ও শর্মিষ্ঠা ১৬৪ ধারায় মহানগর হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ছাড়া এই চারজনকে আটকের আগে শুক্রবার খুলনা থেকে মেডিকেল কলেজে ভর্তির কোচিং সেন্টার থ্রি ডক্টরসের উপদেষ্টা চিকিৎসক ইউনুস উজ্জামান খান তারিমকে আটক করে সিআইডি।
পরে তাকেও একই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। দুপুরে মোট পাঁচজনকে আদালতে হাজির করে সিআইডি। পরে সবার জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানো হয়। প্রায় ২৫ কোটি টাকার লেনদেন’ সিআইডি তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ১৩ অগাস্ট মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের মামলায় মোট ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে সাইবার টিম। এর মধ্যে আটজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভূঁইয়ার কাছ থেকে একটি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়; যার মধ্যে অন্যান্য সদস্যদের নাম পাওয়া যায়। এই অভিযানের ধারাবাহিকতায় খুলনার পাঁচ চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায় সিআইডি। প্রশ্নফাঁস: খুলনার নিখোঁজ ৪ চিকিৎসককে গ্রেপ্তার দেখাল সিআইডি খুলনার স্থানীয় চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউনুচ উজ্জামান খান তারিম (৪০) প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে ২০১৯ সালেও আটক হয়েছিলেন। তিনি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) খুলনা জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। তারিম বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি প্রায় দেড় যুগ ধরে মেডিকেল ভর্তি কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত। খুলনায় থ্রি ডক্টরস কোচিংয়ের তারিম ফের আটক
সিআইডি বলছে, চিকিৎসক তারিম নিজেকে ডাক্তার তৈরির কারিগর হিসেবে পরিচয় দেন। মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। এভাবে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। তার এবং তার স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে প্রায় ২৫ কোটি টাকার লেনদেন পাওয়া গেছে। হাসপাতাল, ফ্ল্যাট, জমি, মাছের ঘের, হোটেলসহ গড়েছেন বিপুল সম্পদ। তারিমের বিরুদ্ধে একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এর আগেও প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠে বলে সিআইডি বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছে। সংবাদ সম্মেলনে পরিবার সোমবার দুপুরে খুলনা বিএমএ মিলনায়তনে চার চিকিৎসকের পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। (তখনও সিআইডি তাদের গ্রেপ্তারের তথ্য জানায়নি।) সংবাদ সম্মেলনে চিকিৎসক তৃষার মা নিলুফার ইয়াসমিন, সৌরভের মা ম্যাকুয়েল সরকার, লামিয়ার মা ফেরদৌসী আক্তার ও শর্মিষ্ঠার বাবা ডা. দীনবন্ধু মণ্ডল উপস্থিত ছিলেন। তারা অভিযোগ করে বলেন, সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা তাদের সন্তানদের নিয়ে যায়। তাদের কোনো কথা বলার সুযোগ দেননি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটি যোগাযোগের মোবাইল নম্বর দিলেও সেটি কেউ ধরছেন না।
লামিয়ার মা ফেরদৌসী আক্তার বলেন, “লামিয়ার আড়াই বছরের একটি শিশুসহ দুটি সন্তান রয়েছে। শিশুরা তাদের মাকে খুঁজছে। একটি শিশু বুকের দুধ পান করে। আমরা কোনোভাবেই তাদের বোঝাতে পারছি না।”শর্মিষ্ঠা মণ্ডলের বাবা ডা. দীনবন্ধু মণ্ডল বলেন, সিআইডি পরিচয়ে শুক্রবার ভোরে তার বানরগাতির সৎসঙ্গ বিহারের সামনের বাসা থেকে মেয়েকে তুলে নেওয়া হয়। এক প্রশ্নের জবাবে অভিভাবকরা দাবি করেন, তাদের সন্তানরা এক সময় খুলনার ডা. তারিমের থ্রি ডক্টর কোচিংয়ে পড়াশোনা করেছে। নিজ নিজ মেধা ও যোগ্যতায় তারা চিকিৎসক হয়েছেন। মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে যা বলা হচ্ছে- তা সঠিক নয়। এদিকে নিখোঁজ চার চিকিৎসকের সন্ধান চেয়ে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারকে চিঠি দেয় চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) খুলনা জেলা শাখা। রোববার রাতে পুলিশ কমিশনারকে দেওয়া ওই চিঠিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে চিকিৎসকদের খুঁজে বের করার দাবি জানানো হয়। প্রশ্নফাঁস: খুলনার নিখোঁজ ৪ চিকিৎসককে গ্রেপ্তার দেখাল সিআইডি বিএমএ খুলনা জেলার সভাপতি শেখ বাহারুল আলম বলেন, তারা কোনো অপরাধে জড়িত থাকলে আইন অনুযায়ী বিচার হবে। কিন্তু কোনোভাবেই আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তিন ধরে নিখোঁজ বা কাউকে আটকে রাখা যায় না। এখানে কী হচ্ছে আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।
১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদালত সূত্র জানায়, সোমবার খুলনার পাঁচ চিকিৎসককে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। তাদের মধ্যে আসামি লুইস সৌরভ ও শর্মিষ্ঠা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত দেন। এরপর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার হাকিম মোহাম্মদ শেখ সাদী আসামি লুইস সৌরভের এবং হাকিম নুরুল হুদা চৌধুরী আসামি শর্মিষ্ঠার জবানবন্দি তাদের খাসকামরায় রেকর্ড করেন। পরে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। এ ছাড়া অপর তিন আসামিকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী জামিন চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাদেরকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আদালত পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের প্রধান উপ-কমিশনার মোহাম।