সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ব্যাংক হিসাবে চার কোটি টাকার পে অর্ডার জমা দেওয়ার অভিযোগে দুই ব্যবসায়ীকে তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ব্যবসায়ী নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ও মো. শাহজাহানকে আগামী ৬ মে এই টাকা জমা দেওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। গতকাল বুধবার সকালে দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের সই করা এক নোটিশে ওই দুই ব্যবসায়ীকে তলব করা হয়। সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখায় সাবেক প্রধান বিচারপতির হিসাবে অস্বাভাবিক এই লেনদেনের তথ্য মিলেছে।
দুদক সূত্র জানায়, গত আড়াই বছরে সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহার ওই ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকারও বেশি। প্রতি মাসে বেতন ছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে লাখ ও কোটির হিসাবে টাকা জমা হয়েছে ২৬ বার। এর মধ্যে গত বছরের ৯ নভেম্বর দুটি পে অর্ডারের মাধ্যমে দুই কোটি করে চার কোটি টাকা জমা হয় তাঁর হিসাবে। এর আগে ৮ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে মো. শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহার ঋণ হিসাব থেকে এই চার কোটি টাকার পে অর্ডার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে ইস্যু করা হয়। জানা গেছে, মো. শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৬ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় দুটি ঋণ হিসাব খোলা হয়। দুটি হিসাবের তথ্য ফরমে বর্তমান ঠিকানা হিসেবে লেখা রয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতির উত্তরার বাড়ির ঠিকানা (সেক্টর নম্বর ১০, সড়ক নম্বর ১২, বাড়ি নম্বর ৫১)। দুজনেরই স্থায়ী ঠিকানা প্রধান বিচারপতির সাবেক পিএস রঞ্জিতের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী এলাকায়। রঞ্জিত বর্তমানে সিঙ্গাপুরপ্রবাসী। সিঙ্গাপুর যাওয়ার আগে তিনি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার উত্তরার বাড়িতে থাকতেন।
সূত্র জানায়, ফারমার্স ব্যাংকে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে চার কোটি টাকা ঋণ নেন ওই দুই ব্যবসায়ী। পরে ঋণের ওই টাকা সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ব্যাংক হিসাবে পে অর্ডারের মাধ্যমে জমা দেওয়া হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতির বিভিন্ন হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে এমন তথ্য-উপাত্ত খুঁজে পায় দুদক। তবে ওই সব লেনদেনের বিষয়ে দুই ব্যবসায়ী জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পেলেও দুদকের কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। দুদকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবে চার কোটি টাকা জমা দেওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই ব্যবসায়ীকে তলব করে নোটিশ জারি করা হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, সাবেক প্রধান বিচারপতিকে টাকা প্রদানকারী একজন মো. শাহজাহান। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ৯৩১২৫৪৭৪৩১২০৩। বাবার নাম আমির হোসেন (মৃত)। ফারমার্স ব্যাংকে করা ঋণ আবেদনে নিজের পেশা হিসেবে চাকরি ও ব্যবসা উল্লেখ
করেছেন। টিআইএন নম্বর ঋণের আবেদনপত্রে উল্লেখ করেননি তিনি। ব্যবসায়ী শাহজাহান গত বছরের ৬ নভেম্বর ঋণ অ্যাকাউন্ট (অ্যাকাউন্ট নম্বর ০১৭৩৫০০১৫৭২৮৬) খোলার পর ৮ নভেম্বর সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে দুই কোটি টাকার পে অর্ডারের জন্য আবেদন করেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পে অর্ডার ইস্যু করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ (পে অর্ডার নম্বর ০০৯২০৪৭)। ওই পে অর্ডারের পর ব্যাংকের এই অ্যাকাউন্টে আর কোনো লেনদেন হয়নি।
সূত্র জানায়, সাবেক প্রধান বিচারপতির ব্যাংক হিসাবে টাকা পাঠানো আরেকজন নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা (জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ১৯৭৬৯৩১২৫৪৭০০০০০১)। বাবার নাম গোলক চন্দ্র সাহা। ব্যাংকের তথ্য ফরমে তাঁর পেশার উল্লেখ নেই। নেই টিআইএনও। গত বছরের ৬ নভেম্বর ঋণ অ্যাকাউন্ট (অ্যাকাউন্ট নম্বর ০১৭৩৫০০১৫৭২২৪) খোলার পর তিনিও ৮ নভেম্বর সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে দুই কোটি টাকার পে অর্ডারের আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পে অর্ডার ইস্যু করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ (পে অর্ডার নম্বর ০০৯২০৪৬)। মো. শাহজাহানের মতো নিরঞ্জন চন্দ্র সাহার অ্যাকাউন্টেও পে অর্ডারের পর আর কোনো লেনদেন হয়নি।
উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে পুনর্বহালের বিধানসংবলিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে গত বছরের ৩ জুলাই রায় দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে ওই রায় দেন। পূর্ণাঙ্গ রায় গত বছরের ১ আগস্ট প্রকাশিত হয়। রায়ে বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতাযুদ্ধ, জাতীয় সংসদ, নির্বাচন কমিশন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী রায় নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন তিনি। এ ছাড়া রায়ে নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কার হাতে থাকবে সে বিষয়ে সংবিধানের ১১৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অবৈধ ও বাতিল বলা হয়। এরই মধ্যে নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে কিছু কথা বলেন প্রধান বিচারপতি। এসব নিয়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সরকারদলীয় নেতারা, মন্ত্রী ও সরকার সমর্থক আইনজীবীরা ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন। প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিও তোলা হয়।
নানা সমালোচনার মধ্য দিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গত বছরের ২ অক্টোবর এক মাসের ছুটি নেওয়ার পর তিনি তা রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেন। পরে তিনি বিদেশে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন। ওই আবেদনে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত তাঁর বিদেশে থাকার কথা উল্লেখ ছিল। ১০ নভেম্বর বা এর কাছাকাছি সময়ে তাঁর দেশে ফেরার কথা বলা হয় আবেদনে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে গত বছরের ১২ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি দেশে না ফেরা পর্যন্ত এবং দেশে ফিরে দায়িত্বভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করবেন।
এক মাস ৯ দিনের ছুটিতে থাকা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গত বছরের ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যান। এর চার দিন পর তাঁর সহধর্মিণী সুষমা সিনহাও অস্ট্রেলিয়ায় যান। পরে তিনি সিঙ্গাপুরে যান।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিদেশে যাওয়ার সময় তাঁর বাসভবনের সামনে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে যে বক্তব্য দেন তা বিভ্রান্তিমূলক হিসেবে অভিহিত করেন সুপ্রিম কোর্ট। এ নিয়ে গত বছরের ১৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলামের সই করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, বিদেশে অর্থপাচার, নৈতিক স্খলনজনিত অভিযোগসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ ওঠার পর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসে বিচারকাজ পরিচালনা করতে আপিল বিভাগের অন্য পাঁচ বিচারপতি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এ কারণে প্রধান বিচারপতি পদত্যাগেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৪ অক্টোবর ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার সঙ্গে আপিল বিভাগের অন্য চার বিচারপতির এক বৈঠক শেষে ওই বিবৃতি দেওয়া হয়।
এরপর গত বছরের ১১ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে অবস্থানকালে তাঁর পদ থেকে পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। অবসরের সময়সীমার দুই মাস ২০ দিন আগে পদত্যাগ করেন তিনি।
বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত তাঁর প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্বে থাকার কথা ছিল। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক এসএম পারভেজ
মোবাইল: +8801716159137
Mail: [email protected]