কামরুল ইসলাম চট্টগ্রামঃ
ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ২০ বছর আগে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলার বহুল আলোচিত মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশ নায়ক মানবতার অগ্রদূত তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আসামিদের সবাইকে খালাস দিয়েছে হাই কোর্ট। আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি করে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চ গতকাল রোববার এ রায় দেয়। বাসস জানায়, রায়ে এ মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বিচারিক আদালতের রায় অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে এ রায় দিয়েছে হাই কোর্ট। জজ আদালত এ মামলায় ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিল। সেই দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিদের করা আপিল মঞ্জুর করার পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আবেদন (ডেথ রেফারেন্স) হাই কোর্ট খারিজ করে দিয়েছে। যারা আপিল করেছেন, তাদের পাশাপাশি যারা করেননি, সবাইকে এ মামলা থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে হাই কোর্টের রায়ে। খবর বিডিনিউজের। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, মুফতি আব্দুল হান্নানের জবানবন্দির ভিত্তিতে যে সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে এ মামলার বিচার শুরু হয়েছিল, সেই অভিযোগপত্রই ছিল অবৈধ। বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার ওই ঘটনা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোড়ন তুলেছিল। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তখন বিরোধী দলীয় নেতা। ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর দণ্ডবিধি ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা দুই মামলার রায় দেন ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। সেই রায়ে বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এছাড়া এ মামলার আসামি ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। সেই রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় ওই হামলা ছিল দলকে নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা। তিনি বলেন, রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে? এটা কাম্য নয়। গতকাল হাই কোর্টের রায়ের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী বিএনপি নেতা কায়সার কামাল বলেন, আওয়ামী লীগের সময়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সম্পূরক চার্জশিটে তারেক রহমানের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যা হাই কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছে। আজকে আমরা, দেশবাসী, জাতি মনে করে, সকলে আজকে ন্যায়বিচার পেয়েছি। আজ মহামান্য আদালত এ চতুর্থ চার্জশিট ও মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে যে চার্জশিটটা দেওয়া হয়, সে চার্জশিটটা আইন বহির্ভূত ছিল। এর আইনগতভিত্তি নেই, তাই খালাস পেয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এ মামলার বিচার এগিয়ে নেওয়া হয়েছিল মন্তব্য করে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, জনাব তারেক রহমান সাহেব আজকের এ রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পেয়েছেন। আজকে প্রমাণিত হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জনাব তারেক রহমান সাহেবকে যে মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছিল সে রায় আইনগতভাবে মোকাবেলার মাধ্যমে তিনি আজকে বেসকসুর খালাস পেয়েছেন। হাই কোর্টে রায়ের সময় কায়সার কামাল ছাড়াও আসামিপক্ষে উপস্থিত ছিলেন এস এম শাজাহান, জয়নুল আবেদীন, মাহবুব উদ্দিন খোকন ও শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন যেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জসিম সরকার। অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে আপলি করা হবে কিনা সে বিষয়ে তারা রায় দেখে ও নির্দেশনা নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন। কেন খালাস: দুই দশক আগে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার মামলায় হাই কোর্টের রায়ে আসামিদের সবাইকে খালাস দেওয়া হয়েছে অভিযোগ গঠনে ত্রুটির কারণ দেখিয়ে। আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি করে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চ গতকাল রোববার এ রায় দেয়।
জজ আদালত এ মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিল। সেই দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিদের করা আপিল মঞ্জুর করার পাশাপাশি মৃত্যদণ্ড কার্যকরের আবেদন (ডেথ রেফারেন্স) হাই কোর্ট খারিজ করে দিয়েছে। জজ আদালতে দণ্ডিত ৪৯ আসামির মধ্যে যারা আপিল করেছেন তাদের পাশাপাশি যারা করেননি, সবাইকে এ মামলা থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে হাই কোর্টের রায়ে। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, মুফতি আব্দুল হান্নানের জবানবন্দির ভিত্তিতে যে সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে এ মামলার বিচার শুরু হয়েছিল, সেই অভিযোগপত্রই ছিল অবৈধ। এছাড়া কোনো সাক্ষী কোনো আসামিকে গ্রেনেড ছুড়তে দেখেননি, তাই শুধু স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে সাজা দেওয়া যায় না বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে কোর্ট।
রায়ের পর আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী শিশির মনির বলেন, মুফতি হান্নানের দুইবার কনফেশন নেওয়া হয়েছে। তার ওপর ভিত্তি করে বিচারিক আদালত রায় দেয়। উপমহাদেশের চারশ বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয় কনফেশনের ওপর ভিত্তি করে সাজা দেওয়ার ঘটনা আর ঘটেনি। এবার আমরা এর সাক্ষী হলাম। আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, এ মামলায় দুইবার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এক আসামির দ্বিতীয়বার কনফেশন (ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি) নিয়ে পরে আরেকটি চার্জশিট দেওয়া হয়, যেটা আইনে গ্রহণযোগ্য নয়। আদালতে আমরা এটা বলেছি, আদালত সেটা গ্রহণ করেছে। এছাড়া সাক্ষীরা কোনো আসামিকে গ্রেনেড ছুড়তে দেখেননি। তাই সব আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এ রকম একটি মর্মান্তিক ঘটনায় আমরা সবাই ব্যথিত। কিন্তু ইচ্ছা করলেই তো যে কাউকে আসামি করে সাজা দেওয়া যায় না। এ রায়ে তাই প্রমাণ হয়েছে। গতকাল হাই কোর্টের রায়ের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন জানান, এখানে মূল বিষয়টি আরম্ভ হয়েছে জনসভার পারমিশন নিয়ে। জনসভার পারমিশন সরকার দিয়েছিলেন পাশের একটি মাঠে। সরকারকে পরবর্তী পর্যায়ে না জানিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ওই স্থান পরিবর্তন করে এ রাস্তার মধ্যে নিয়ে আসেন। এটা ছিল তার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যে সরকারি দলকে একটা বেকায়দায় ফেলাবার জন্য তিনি এ কাজটি করেছিলেন। সেজন্য এ যে গ্রেনেড হামলাটা হয়েছিল, আমাদের বিশ্বাস–রাজৈনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ গ্রেনেড হামলটা তখন হয়েছিল। তিনি বলেন, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় চার্জশিটে তারেক রহমানের নাম কোথাও ছিল না। সাবসিকোয়েন্টলি আব্দুল কাহার আকন্দকে দিয়ে এ মামলার মধ্যে তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করেন। তাকে সম্পৃক্ত করে এ মামলায় সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।জয়নুল বলেন, আদালত সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করেছে, দেখেছে যে সাক্ষ্যে, যে চার্জশিটে তাদেরকে সাজা দেওয়া হয়েছে, এমনকি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, এ মৃত্যুদণ্ড টিকতে পারে না। ডাইরেক্ট কোনো এভিডেন্স না থাকলে কাউকে মৃত্যদণ্ড দেওয়া যায় না, সেখানে আজীবন সাজাও দেওয়া যায় না। তার ভাষ্য, সমস্ত দিক বিচার বিশ্লেষণ করে আদালত মনে করেছে এ মামলায় যারা আপিল করেছে এবং যারা আপিল করতে পারেনি প্রত্যেকেকেই খালাস দেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন,এ মামলাটিকে সারা বছর আওয়ামী লীগ সরকার ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। তারা চেয়েছিল তারেক রহমানকে মামলা দিয়ে চিরজীবন তাকে বাইরে রাখবেন এবং এমনকি তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদালত এ রকম কোনো এভিডেন্স পায়নি যে তারেক রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। আজকে এ জাজমেন্টের মাধ্যমে সবাই খালাস পেলেন।
সম্পাদক ও প্রকাশক এসএম পারভেজ
ফ: +8801716159137
Mail: [email protected]